খাদ্য আন্দলন ~ শতদ্রু দাস - All Technology

This is a Technology Blog site.If you have a desire to learn, but a repository of knowledge for you to this page.Now that the technology will continue to become more self-reliant development of the last corner.I will attempt to present something new for everyone.

Recent Posts

Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

Wednesday, September 2, 2015

খাদ্য আন্দলন ~ শতদ্রু দাস

"মা! একটু ফ্যান দিবি?"
মানিক, সন্দীপন বা কমলকুমার প্রভৃতি সাহিত্যিকের লেখায়, গায় কাঁটা দেওয়া এই আর্ত চিতকার অনেকে শুনেছেন। গ্রামে খাবার না পেয়ে, ক্ষুদার্ত মানুষের ভিড় ৫-এর দশকে আকছার দেখা যেতো কলকাতায়। তাঁরা হাতে এলুমিনিয়ামের পাত্র নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন ভাতের ফ্যান (মাড়) চেয়ে। আমি বাংলা সাহিত্যে পড়বার অনেক আগেই বাবার কাছে এই গল্প শুনেছিলাম। কিন্তু সেই মানুষ শুধু ভিক্ষে করেনি, মরতে মরতেও খাদ্যের দাবিতে এক ঐতিহাসিক লড়াই করে গেছিলেন যাকে আমরা বলি "খাদ্য আন্দোলন।"
আজ খাদ্য আন্দোলনের ওপর পুলিশী আক্রমনের ৫৬-তম বার্ষিকী। এই দিনটি বাংলার রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়, স্বাধীন ভারতে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহনে এরকম জঙ্গি আন্দোলন ইতিপূর্বে ঘটেনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলত তিনটি ধারা ছিলো। এক হলো গান্ধীজির শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন যাতে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ অংশ নিতেন প্রতিবাদ মিছিল, অনশন, বয়কটের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত ছিলো সশস্ত্র আন্দোলন, গেরিলা কায়দায় অতর্কিতে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সশস্ত্র আক্রমন করা অথবা সুভাস বোসের মত সশস্ত্র সেনাবাহিনী তৈরী করে মুক্তাঞ্চল গড়া - এই দুই রণকৌশলেই সাধারণ মানুষের অংশ নেওয়ার উপায় ছিলো না। তৃতীয় ধারাটি মূলত গ্রামের দিকে। তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানা আন্দোলন বা কেরলের মালাবার বিপ্লব সব ক্ষেত্রেই গ্রামের কৃষকরা একত্রিত হয়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশবাহিনী পুষ্টিত জমিদার অথবা রাজাদের বিরুদ্ধে। খাদ্য আন্দোলন এসবের থেকে ভিন্ন। এই ক্ষেত্রে আন্দোলন সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে এবং আন্দোলনের রণকৌশল ছিলো শাসকের প্রাণকেন্দ্র - শহর চত্তরের দখল নিয়ে, প্রশাসনকে স্তব্ধ করে দেওয়া। গান্ধীজির সত্যাগ্রহের মতই এতে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহন ছিলো কিন্তু সত্যাগ্রহের মতো নিরীহ আন্দোলন নয়, প্রশাসনের ল্যাজে পা দিয়ে আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য আন্দোলনই ভবিষ্যতের অনেক আন্দোলনের রূপরেখা তৈরী করে দেয়। পশ্চিমবাংলা তথা ভারতবর্ষে বাম রাজনীতিকে তার আন্দোলনের কায়দা শিখিয়ে দেয়।
স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। একদিকে স্বাধীনতা পাওয়ার দরুন অর্থনৈতিক ও প্রশাসনের কাঠামোগত বদল আর তার ফলে উত্পাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়া এবং অপর দিকে দেশভাগের ফলে লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারার চাপ। পরিস্থিতি ঘোরালো হতে শুরু করে ৫-এর দশকের মাঝামাঝি এসে। আর তার পেছনে বিধান রায়ের কংগ্রেস সরকার অধিকাংশে দায়ী। উত্পাদনে বৃদ্ধি হওয়া সত্তেও সরকারের খাদ্য সংগ্রহে ব্যাপক ঘাটতি শুরু হয়। খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের তত্বাবধানে গণবন্টন ব্যবস্থাকে এক রকম অকেজো করে দেওয়া হতে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে যে খাদ্য শস্য উত্পাদন ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫-এর ভেতর ৪ কোটি ৮০ লক্ষ টন থেকে বেড়ে ৬ কোটি ১০ লক্ষ টন হলেও খাদ্যশষ্যর গণবন্টন ৮০ লক্ষ টন থেকে নেমে আসে মাত্র ১৬ লক্ষ টনে। এর ফলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে খাদ্যশস্যের দাম, বিশেষ করে চালের দাম। বামপন্থীরা অভিযোগ করে যে ভূমিহার, জোতদার এবং রাইস মিলের মালিকদের সাথে আরতদারদের আঁতাত তৈরী হয়েছে এবং সেই কারণেই ইচ্ছে করে খাদ্যের সংকট তৈরী করা হচ্ছে দাম বাড়ানোর জন্যে, বাংলায় কংগ্রেসের মূল জনভিত্তি ছিলো বড় চাষী এবং আরতদাররা তাই সরকার একে প্রশ্রয় দিচ্ছে। ১৯৫৬-তে যেখানে ১ টাকায় আড়াই কিলো চাল কেনা যেতো, দাম বাড়তে বাড়তে ১৯৫৮-এর শেষদিকে খোলা বাজারে ১ কিলো চালের দাম প্রায় এক টাকা হয়ে দাঁড়ায়। রেশন দোকানে বিরাট লাইন কিন্তু চালের যোগান নেই। বিধানসভায় বামেরা বার বার প্রশ্ন তুললেও প্রফুল্ল সেন এবং বিধান রায় বলেন যে কোনো সংকট নেই, বাজারে যথেষ্ঠ চাল রয়েছে। প্রফুল্ল সেন বলেন চালের সংকট শুধু কোলকাতায়, গ্রামে কোনো সমস্যা নেই যা ছিলো সর্বৈব মিথ্যা। তিনি মানুষকে রুটি খেতে বলেন ভাত না খেয়ে যাতে বিরোধীদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। শেষমেষ বিরোধীদের এবং সংবাদ মাধ্যমের চাপের মুখে পড়ে সরকার ঠিক করে বাজারে চালের দাম বেঁধে দেওয়া হবে। কিন্তু পরিস্থিতির এতে আরো অবনতি ঘটে। দাম বেঁধে দেওয়া হবে শুনে কালোবাজারীরা বাজার থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য সরিয়ে ফেলে। হাহাকার দেখা যায় চতুর্দিকে। দাম বেঁধে দেওয়া তখনই কার্য্যকর হতে পারে যখন সরকার মজুতদারদের গুদামে হানা দিয়ে এটা নিশ্চিত করতে পারে যে মজুতদাররা খাদ্যশস্য জমাচ্ছে না। কিন্তু কংগ্রেস সরকার সেই পথেই হাঁটেনি, বিধানসভায় তারা বলে যে মজুতদাররা খাদ্যশস্য সরিয়ে রাখছে এমন প্রমান নেই। অথচ বিরোধী বিধায়কদের তৈরী করা জনগনের কমিটি বিভিন্ন বাজারে হানা দিয়ে প্রচুর খাদ্যশস্য জমে থাকার প্রমান জোগার করেন। কিন্তু সরকারী সহায়তা না থাকার ফলে সেই উদ্যোগ বেশি দূর যায় না। খাদ্যসংকট তীব্রতর হচ্ছে দেখে সরকার ডিগবাজি খায় ও ফের বাঁধা দাম উঠিয়ে দেয় কিন্তু তত দিনে প্রবল খাদ্যসংকটের ফলে শস্যের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেছে। ইচ্ছে করেই হোক অথবা ভুলবশত, এই দাম বেঁধে দেওয়া এবং তারপর কৃত্রিম সংকট তৈরী হওয়ার পর তা তুলে নেওয়া এই প্রক্রিয়ায় আরতদারেরা বিশাল লাভ করে। সাধারণ মানুষ মনে করতে থাকে যে আরতদার ও কালোবাজারীদের (বেশিরভাগ সময়তে দুটো এক) সাথে কংগ্রেস সরকারের যোগসাজস আছে। যুগান্তর, আনন্দবাজার, স্টেট্সম্যান, অমৃতবাজার প্রভৃতি পত্রিকা সরকারকে কাঠগোড়ায় তোলে।
এর মধ্যে বামেরা প্রফুল্ল সেনের পদত্যাগ চেয়ে এবং গণবন্টন ব্যবস্থার অবিলম্বে উন্নতির দাবিতে জমায়েত করতে থাকে। ৩১-এ অগাস্ট ১৯৫৯-এ ডাক দেওয়া হয় মহাকরণ অভিযানের। সরকার ভয় পেয়ে ৬ হাজারেরও বেশি বাম কর্মী ও নেতাদের গ্রেপ্তার করে মিছিলের আগেই তবুও অভিযান আটকানো যায়নি । অভিযানের ডাকে সাড়া দিয়ে গ্রামবাংলা এবং কলকাতা ও হাওড়ার শহরতলি থেকে লক্ষ লক্ষ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র এবং বাস্তুহারা মানুষ কলকাতার রাজপথের দখল নেয়। সেই মিছিলে নারীদের অংশগ্রহন ছিলো অভূতপূর্ব, স্বাধীনতা আন্দোলনেও নারীদের এরকম সতস্ফুর্ত অংশগ্রহন দেখা যায়নি। কোলে বাচ্চা নিয়ে মিছিলে আসেন হাজার হাজার কৃষিনি। অঝোর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মিছিল ময়দান থেকে মহাকরণের দিকে যাত্রা শুরু করলে পুলিশ আটকায়। বাম নেতারা সেখানে স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হোন। নেতাদের দেখে অনেক কর্মীরাও গ্রেপ্তার হওয়ার জন্যে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলে। পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকার ফলে, পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে বেরিয়ে যায় এবং ঘোড়সওয়ার পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালাতে শুরু করে। ভয় পেয়ে মানুষ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় প্রথমে কিন্তু তারপর পাল্টা পাথর ছুঁড়ে প্রত্যাঘাত করে। এর মধ্যে বহু মানুষ প্রথমবার কলকাতা এসেছিলেন গ্রাম থেকে, তারা শহরের বিন্দুমাত্র চিনতেন না, ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েন অনেকে এবং কিছুটা সেই ভয় থেকেই পুলিশকে আক্রমন করেন। অফিসফেরতা মানুষ ও সাধারণ ছাত্র ছাত্রী, যারা মিছিলে যাননি তারাও পুলিশের বিবেচনাহীন বর্বরতা দেখে আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান, তাদেরকে পালাতে সাহায্য করেন এবং আশ্রয় দেন। সোনাগাছি বা হাড়কাঁটা গলির বেশ্যারাও প্রচুর মানুষকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেন। শ্রমজীবি মানুষের এহেনো একতা এর আগে পশ্চিমবাংলা দেখেনি। প্রশাসন সেই একতা দেখেই আরো নির্মম হয় বোধয়। কলকাতার রাজপথ মৃত্যু উপত্যকার রূপ নেয়। রাস্তার আলো নিভিয়ে চলতে থাকে হত্যালীলা। সরকার মৃত্যুর কথা অস্বীকার করলেও বহু বহু প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় পাওয়া যায় রাস্তার ওপর মা আর শিশুর নিথর দেহ, গঙ্গা এবং বাগবাজার খালে ভেসে থাকা মৃতদেহ, এবং ভোরবেলা পুলিশের গোপনে রাস্তা থেকে মৃতদেহ তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে দাহ করা। বামেরা দাবি করে ৮০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ১০০০-এরও বেশি মানুষ নিখোজ। শেষমেষ কত জন মারা গেছিলো তারা স্পষ্ট হিসেব আজও মেলেনি। কিন্তু কলকাতার মানুষ তো সাক্ষী ছিলেন, তারা দেখেছেন পুলিশের বর্বরতার নমুনা। তাই ১ সেপ্টেম্বর কলকাতার রাস্তা ফের দখলে চলে যায় প্রতিবাদীদের। এবার আর গ্রাম থেকে আসা মানুষ না, প্রতিবাদ করেন ছাত্ররা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়তে জমায়েত হয় এক লক্ষ ছাত্র ছাত্রীর এবং সেখান থেকে পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধ ছড়িয়ে পরে গোটা কলকাতায়। ফরাসী বিপ্লবের সময়কার প্যারিসের কায়দায় ভাঙ্গা টেবিল, চেয়ার, ঠ্যালা গাড়ি ইত্যাদি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করেন সাধারণ মানুষ, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের গাড়িতে। তাদের লক্ষ্য বর্বর পুলিশের হাত থেকে শহরের শাসন ভার ছিনিয়ে নেওয়া। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় অনেকের, সরকারী হিসেবে ১২ জন হলেও আসল সংখ্যা অনেক বেশি। ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে হাওড়া শহরে। এবার নেতৃত্বে কারখানার শ্রমিকরা। ফের একই কায়দায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করে মানুষের মুক্তাঞ্চল তৈরী করা। পুলিশ বেধরক লাঠি এবং গুলি চালায়। ৩১ অগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বরের সেই আন্দোলনে পুলিশের হিসেব অনুযায়ী ৪১ জন নিহত হন পুলিশের হাতে কিন্তু বিরোধী দল ও বিভিন্ন সংবাদপত্রের হিসেব অনুযায়ী সংখ্যাটা কয়েক গুন বেশি। কোনো তদন্ত কমিশন বসেনি সেই বর্বরতা নিয়ে। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে কেন্দ্র সরকার নড়েচরে বসে এবং খাদ্যসংকটের খানিক সুরাহা হয়। গণবন্টনে খাদ্যশস্যের যোগান বাড়ে। এই আন্দোলন হয়তো সম্পূর্ণ সফল হয়নি, কিন্তু এর রূপরেখা পরবর্তী আরো আন্দোলনের ব্লু প্রিন্ট তৈরী করে দেয়। ট্রামভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ দ্বিতীয় খাদ্য আন্দোলন সবই ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলনের ছাঁচে তৈরী। প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের এক নতুন ধরন শিখিয়ে দেয় মানুষকে। দেখিয়ে দেয় রাষ্ট্রের সাথে লড়তে গেলে সবসময় বন্দুক গুলি বা সামরিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। রান্নাঘরের আঁশবটি, কৃষকের কাস্তে ও শ্রমিকের হাতুরিও প্রয়োজনে হাতিয়ার হতে পারে।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot

Pages