
বার্সেলোনা কোচ লুই এনরিকের কাছে তিনি, 'অ্যাথলেটিকসের মেসি'! আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট সেবাস্টিয়ান কো'র আবার তাঁকে দেখে মনে পড়ে কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর কথা! নিজ ভুবনে তিনি 'ভিনগ্রহে'র ফুটবলার মেসির মতোই অদম্য। আবার আলীর মতো প্রভাববিস্তারকারী!
তিনি উসাইন বোল্ট। ট্র্যাকের 'বজ্রবিদ্যুৎ'! স্প্রিন্ট বলতেই মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে এই একটি নাম। যিনি নিজেই একটা ব্র্যান্ড। ১৯৭৭ সালে অটোমেটিক সময় গণনা বাধ্যতামূলক করার পর ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট ডাবলে বিশ্ব রেকর্ডধারী একমাত্র অ্যাথলেট। স্প্রিন্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ও সফল স্প্রিন্টার! অলিম্পিক স্প্রিন্টে টানা ৬ সোনা, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে
১১টি। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে রূপকথার অভিযাত্রা শুরুর পর অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ মিলিয়ে ১৮টি সোনার মধ্যে ১৭টিই জ্যামাইকার এই গতি-মানবের। সংখ্যাটা ১৮ হয়নি দায়েগুতে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ডিসকোয়ালিফায়েড হওয়ায়।
১১টি। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে রূপকথার অভিযাত্রা শুরুর পর অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ মিলিয়ে ১৮টি সোনার মধ্যে ১৭টিই জ্যামাইকার এই গতি-মানবের। সংখ্যাটা ১৮ হয়নি দায়েগুতে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ডিসকোয়ালিফায়েড হওয়ায়।
অথচ সময়ের হিসাব করলে বছরে দৌড়ান তিনি মোটে কয়েক মিনিট। তাতে দোলা দিয়ে যান সারা দুনিয়ার কোটি ভক্তের হৃদয়ে। ছয় বছর আগে বার্লিনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন ৯.৫৮ সেকেন্ডে। প্রতি সেকেন্ডে দৌড়েছিলেন ১২.২ মিটার। একজন মানুষের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সীমানা নির্ধারণে বিজ্ঞানীদের নতুন করে গবেষণা করতে হচ্ছে বোল্টের অমন অতিমানবীয় কীর্তিতে। নিজের পারফরমেন্সের গ্রাফ তিনি এতটাই উঁচু থেকে উঁচুতে তুলে নিয়ে গেছেন যে ওই স্বপ্নশৃঙ্গে পৌঁছানো রক্ত-মাংসের গড়া কোনো মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেটাও আজ বড় প্রশ্ন।
আর বোল্টের পাশাপাশি ট্র্যাকে এখন চলছে জ্যামাইকান রাজ। অলিম্পিক কিংবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা ডায়মন্ড লিগ, ক্যারিবীয় এই দ্বীপরাষ্ট্রটির পতাকা পত পত করে উড়ছে সবখানে। বেইজিংয়ে সদ্য শেষ হওয়া বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও ৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে ঝলমল করছে কিনা ৩০ লাখের দেশ জ্যামাইকা। তাদের সমান সোনা কেবল কেনিয়ার। কেনিয়ার অর্জনগুলো অবশ্য দূরপাল্লার দৌড়ে। স্প্রিন্টে জয়জয়কার জ্যামাইকানদেরই। আর তাদের নিরঙ্কুশ এ রাজত্বের অন্যতম রূপকার ওই একজনই। বোল্ট। এবারও বেইজিংয়ে জিতেছেন ত্রিমুকুট। ১০০ ও ২০০ মিটারের পর হেসেছেন ৪ী১০০ মিটার রিলেতেও।
বছরের সেরা টাইমিং করে জাস্টিন গ্যাটলিন হুঙ্কার দিয়ে নেমেছিলেন বেইজিংয়ের ট্র্যাকে। কিন্তু বোল্টের রাজত্বে হানা দেওয়ার সাধ্য যে কারো নেই! বরং বোল্টের পেছনে থেকে দ্বিতীয় হতে পারাতেও যেন পরম তৃপ্তি গ্যাটলিনদের। অনেকে পরিচ্ছন্নতা বনাম কলঙ্কের লড়াইয়ের তমকাও সেঁটে দিয়েছিলেন বোল্ট-গ্যাটলিনের এবারের দ্বৈরথকে। জ্যামাইকান গতিদানবের বিজয়ে সেই লড়াইয়ে জয় হয়েছে যেন বিশুদ্ধতারই!
এবার চোখ রাখুন মেয়েদের স্প্রিন্টে। ১০০ মিটারের রানি বোল্টের দেশেরই শেলি-অ্যান ফ্রেজার প্রাইস। ৪ী১০০ এবং ৪ী৪০০ রিলের দুটি সোনাও জিতেছে টিম জ্যামাইকা। এর সঙ্গে যোগ করুন ১০০ মিটার হার্ডলসে ড্যানিয়েল উইলিয়ামসের মুকুটটি। সব মিলিয়ে বেইজিংয়ের বিশ্ব আসরে এবার ৭টি সোনার পদক জিতেছে টিম জ্যামাইকা। এর সবগুলোই আবার স্প্রিন্টে। ও হ্যাঁ, ইয়োহান ব্লেকের মতো চ্যাম্পিয়ন স্প্রিন্টার ট্র্যাকের বাইরে ছিটকে পড়ার পরও কিন্তু অমন বর্ণিল কীর্তি বোল্টের দেশের।

ট্র্যাকে সাম্প্রতিক সময়ে জ্যামাইকান রাজত্বের এটা একটা খণ্ডচিত্র মাত্র। অলিম্পিকেও এখন মার্কিন শ্রেষ্ঠত্বে হানা দিয়ে চলছে জ্যামাইকার শাসন। একটু পেছন ফিরে তাকালে চিত্রটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪টি সোনার বিপরীতে জ্যামাইকা জিতে মোটে একটি। এবার তারাই ওপরে। অলিম্পিকের চিত্রটাও পাল্টেছে বোল্টদের আগমনে। ১৯৯২ সালের বার্সেলোনা অলিম্পিকে মার্কিনিদের ১৩ সোনার বিপরীতে একটিও সোনা জিততে পারেনি সেবার জ্যামাইকা। ২০০৮ থেকে 'বিদ্যুচ্চমকে' সেটা যায় উল্টে। বেইজিং অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্র ৭টি আর জ্যামাইকা জেতে ৬টি। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৯ সোনার বিপরীতে জ্যামাইকার অর্জন ৭টি। তথ্যচিত্র যদি হয় শুধু স্প্রিন্টের সেখানে জ্যামাইকার নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব!
তো ক্যারিবীয় এই দ্বীপরাষ্ট্রের আকাশছোঁয়া অমন রঙিন সাফল্যের রহস্যটা কী! প্রতিভা, নিয়মানুবির্ততা, অনুশীলন ও পরিশ্রমের দুর্দান্ত রসায়নের ফসল, নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনো গোপন কারণও আছে? শুধু প্রতিভার ছড়াছড়ি থাকলেই তো আর শ্রেষ্ঠত্বে যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রবল পরাক্রমশালী ক্রীড়াশক্তিকে পেছনে ফেলা সম্ভবপর নয়। এ জন্য ভিতটাও হতে হয় ইস্পাত সমান মজবুত। প্রতিভাবানদের বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়ানোর উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য সঠিক পরিচর্যাও আবশ্যক। বোল্ট-ফ্রেজার-ইয়োহান ব্লেকদের মনে আত্মবিশ্বাসের সেই বীজটা বুনে দেওয়া হয় শৈশবেই। জ্যামাইকানদের দুনিয়া কাঁপানো অ্যাথলিট তৈরির সেই মঞ্চই হচ্ছে 'দ্য চ্যাম্পস'। বিশেষজ্ঞদের মতে বোল্টদের আকাশছোঁয়া সাফল্যের রহস্যও আর কিছু নয়, ওই 'দ্য চ্যাম্পস'।
জ্যামাইকার জাতীয় স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপের আরেক নাম হচ্ছে 'দ্যা চ্যাম্পস'। প্রতিভাবান তরুণ অ্যাথলেটদের নিজেদের মেলে ধরার মঞ্চ। যেখানে ছেলেদের তিনটি বয়স শ্রেণি এবং মেয়েদের চারটি বয়স শ্রেণিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ভবিষ্যৎ বিশ্ব তারকার খোঁজে। তাই বলে এই মঞ্চে আলো ছড়ানো মানেই যে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও অলিম্পিকের মতো বড় আসরে দ্রুত সাফল্যের চাবিকাঠি হাতে পাওয়া, বিষয়টা তেমন নয় মোটেও। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত বোল্ট নিজে।
'দ্য চ্যাম্পসে' ক্লাস থ্রি মানে অনূর্ধ্ব-১৪তে কোনো শিরোপা না জিতেও তো ২০০২ সালে বিশ্ব যুব অ্যাথলেটিকস দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসেন 'বজ্রবিদ্যুৎ'। অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ভ্যারোনিকা ক্যাম্পবেল ব্রাউন ও শেলি-অ্যান ফ্রেজার প্রাইসও 'দ্য চ্যাম্পসে' বাজেভাবে হেরেছিলেন কম বয়সে। স্কুল প্রতিযোগিতায় বড় নাম ছিলেন না ১০০ মিটারের সাবেক বিশ্বরেকর্ডধারী আসাফা পাওয়েলও। মারলিন ওটি, আর্থার উইন্ট, হার্ব ম্যাককিনলির মতো তারকাদের বিকশিত হওয়ার বড় জায়গা ছিল আবার এই 'দ্য চ্যাম্পস'।
স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত ক্রীড়া লেখিয়ে রিচার্ড মুর জ্যামাইকানদের রূপকথার সাফল্য নিয়ে 'দ্য বোল্ট সুপ্রিমেসি; ইনসাইড জ্যামাইকান স্প্রিন্ট ফ্যাক্টরি' নামে একটি বই লিখেছেন। স্প্রিন্টে জ্যামাইকানদের উত্থানে 'দ্য চ্যাম্পসে'র ভূমিকা কতটুকু সে সম্পর্কে মুর লিখেছেন, 'এই মিটের মান অত্যন্ত ভালো। এই মিট থেকে যারা উঠে আসবে তারা ভালো করবে এটা তো স্বাভাবিকই।' শৈশবের শুরুটাই হয় যাদের এতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা তো অন্যভাবে গড়ে উঠবেনই।
ফুটবল ক্যারিবীয় এই দ্বীপেও খুব জনপ্রিয়। ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বেও খেলেছে জ্যামাইকা। আর ক্রিকেট? ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলেও খেলোয়াড় সরবরাহে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে শীর্ষসারিতে থাকবে জ্যামাইকা। জনপ্রিয়তায় অ্যাথলেটরা অবশ্য অন্য সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। বোল্টের আকাশচুম্বী সাফল্যে নিঃসন্দেহে এটা এখন আরো সুপ্রতিষ্ঠিত!
অর্থনৈতিকভাবে মার্কিনিদের ধারেকাছেও হয়তো নেই পুঁচকে জ্যামাইকা, তবে এই একটি জায়গায় আমেরিকাকে সমানতালে টেক্কা দিচ্ছে জ্যামাইকা। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এখন তো জ্যামাইকান রাজ!
No comments:
Post a Comment